ফকল্যান্ডস যুদ্ধ
ফকল্যান্ডস যুদ্ধ | |||||||
---|---|---|---|---|---|---|---|
মানচিত্রে ফক্ল্যান্ড দ্বীপপুঞ্জের অবস্থান | |||||||
| |||||||
বিবাদমান পক্ষ | |||||||
আর্জেন্টিনা |
যুক্তরাজ্য ফক্ল্যান্ড দ্বীপপুঞ্জ | ||||||
সেনাধিপতি ও নেতৃত্ব প্রদানকারী | |||||||
রাষ্ট্রপতি লেওপোলদো গালতিয়েরি ভাইস-অ্যাডমিরাল হুয়ান লোম্বার্ডো ব্রিগেডিয়ার-জেনারেল এর্নেস্তো হোরাসিও ক্রেস্পো ব্রিগেড-জেনারেল মারিও মেনেন্দেস |
প্রধানমন্ত্রী মার্গারেট থ্যাচার অ্যাডমিরাল জন ফিল্ডহাউস রিয়ার-অ্যাডমিরাল স্যান্ডি উডওয়ার্ড মেজর-জেনারেল জেরেমি মুর | ||||||
হতাহত ও ক্ষয়ক্ষতি | |||||||
৬৪৯ জন নিহত ১,০৬৮ জন আহত ১১,৩১৩ জন বন্দী ৭৫টি উড়োজাহাজ ২৫টি হেলিকপ্টার ১টি হালকা ক্রুজার ১টি ডুবোজাহাজ ৪টি মালবাহী জাহাজ ২টি প্যাট্রোল বোট ১টি স্পাই ট্রলার |
২৫৮ নিহত[১] ৭৭৭ জন আহত ১১৫ জন বন্দী ৬টি সি হ্যারিয়ার ৪টি হ্যারিয়ার GR.3 ২৪টি হেলিকপ্টার ২টি ডেস্ট্রয়ার ২টি ফ্রিগেট ১টি ল্যান্ডিং শিপ ১টি উভচর যান ১টি কন্টেইনার জাহাজ ৪টি প্রত্যাহারকৃত জাহাজ |
ফক্ল্যান্ড্স যুদ্ধ (ইংরেজি: Falklands War; স্পেনীয় ভাষায়: Guerra de las Malvinas/Guerra del Atlántico Sur) ছিল দক্ষিণ আটলান্টিক মহাসাগরে ফক্ল্যান্ড দ্বীপপুঞ্জের (আর্জেন্টিনীয়দের দেয়া নাম Islas Malvinas ইসলাস মালবিনাস) নিয়ন্ত্রণের উপর আর্জেন্টিনা ও যুক্তরাজ্যের মধ্যে সংঘটিত অঘোষিত যুদ্ধ। ১৯৮২ সালের ২রা এপ্রিল থেকে ১৪ই জুন পর্যন্ত এই যুদ্ধ চলে।
ফক্ল্যান্ড দ্বীপগুলি আর্জেন্টিনার পূর্ব উপকূল থেকে ৪৮০ কিমি দূরে অবস্থিত। ১৫৯২ সালে ব্রিটিশ নাবিকেরা সম্ভবত এগুলি প্রথম আবিষ্কার করে। কিন্তু আর্জেন্টিনার উপকূলের কাছে অবস্থিত হওয়ায় আর্জেন্টিনা ১৯শ শতকের শুরু থেকেই এই দ্বীপগুলিকে নিজেদের বলে দাবী করে। আর্জেন্টিনীয়রা এগুলিকে "মালবিনাস দ্বীপপুঞ্জ" (Islas Malvinas) নামে ডাকে। আর্জেন্টিনার যুক্তি ছিল ১৭৬০-এর দশক থেকে, অর্থাৎ ব্রিটিশদের আসার অনেক আগে স্পেনীয়রা এখানে বসতি স্থাপন করেছে। ১৮৩৩ সালে এখানে ব্রিটিশদের বসতি ও নিয়ন্ত্রণ স্থাপিত হয় এবং তখন থেকেই যুক্তরাজ্য দ্বীপগুলির উপর আর্জেন্টিনার দাবী অগ্রাহ্য করতে থাকে। ১৯৪৫ সালে ২য় বিশ্বযুদ্ধের পরে আর্জেন্টিনা আবার তাদের দাবী উত্থাপন করে এবং ১৯৬৫ সালে জাতিসংঘের মাধ্যমে ব্রিটেনের সাথে সমঝোতায় আসার চেষ্টা করে। ১৯৭০-এর দশকে ব্রিটেন আর্জেন্টিনাকে দ্বীপগুলি দিয়ে দেবার ব্যাপারে ইচ্ছুক হবার আভাস দেয়। একটি সমাধান ছিল একবারে দ্বীপগুলিকে ফেরত না দিয়ে ধীরে ধীরে ধাপে ধাপে দেয়া। এই সমাধান অনুসারে দ্বীপগুলি আর্জেন্টিনার আয়ত্তে থাকবে, কিন্তু ব্রিটেন এগুলির প্রশাসন চালাবে। কিন্তু ফকল্যাণ্ড দ্বীপবাসী ব্রিটেনের অধীনেই থাকার ব্যাপারে সম্মতি দেয়, এবং ১৯৮২ সালে এ-সংক্রান্ত আলোচনা ভেস্তে যায়। ১৯৮২ সালের মার্চ মাসের শেষের দিকে আর্জেন্টিনার রাষ্ট্রপতি লেওপোলদো গালতিয়েরি দ্বীপগুলি জোর করে দখল নেয়ার পরিকল্পনা করেন। গালতিয়েরির এই আক্রমণের পেছনে রাজনৈতিক কৌশলও কাজ করছিল। সেসময় অর্থনৈতিক সমস্যায় জর্জরিত আর্জেন্টিনার জনগণের মধ্যে ব্যাপক অন্তর্কলহকে সামাল দিয়ে তাদেরকে সামরিক সরকারের পেছনে এক কাতারে আনতে এবং বিদেশে ক্রমশ বিতর্কিত ও নিন্দিত সামরিক সরকারের মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়গুলিকে চাপা দিতে গালতিয়েরি এই চাল চালেন বলে অনেকে ধারণা করেন। এই লক্ষ্যে আর্জেন্টিনাতে গোপনে একটি আক্রমণ দল প্রস্তুতি নিতে থাকে। এ সময় ফক্ল্যান্ড্স দ্বীপপুঞ্জের ১৬০০ কিলোমিটার পূর্বে ব্রিটিশ-নিয়ন্ত্রিত সাউথ জর্জিয়া দ্বীপে অবস্থানরত আর্জেন্টিনীয় সাহায্যকর্মী এবং ব্রিটিশ বৈজ্ঞানিকদের মধ্যে বিবাদের সৃষ্টি হয়। ফলে আক্রমণের নির্ধারিত সময়সীমার আগেই আর্জেন্টিনা সাউথ জর্জিয়া দ্বীপে তিনটি যুদ্ধজাহাজ পাঠায়। সেখানে যাবার পথে ২রা এপ্রিল এই নৌবহরই ফক্ল্যান্ড্স দ্বীপপুঞ্জ আক্রমণ করে। আর্জেন্টিনার সেনারা দ্বীপগুলির রাজধানী পোর্ট স্ট্যানলিতে অবস্থিত ক্ষুদ্র ব্রিটিশ সৈন্যদলকে সহজেই পরাজিত করে। তবে আদেশ অনুযায়ী নিজেদের ক্ষয়ক্ষতি ও প্রাণহানি হলেও তারা কোন ব্রিটিশ প্রাণহরণ করেনি। এর পরের দিন ৩রা এপ্রিল আর্জেন্টিনীয়রা সাউথ জর্জিয়া দ্বীপ ও সাউথ স্যান্ডউইচ দ্বীপপুঞ্জ দখলে নেয়। এপ্রিলের শেষের দিকেই ফক্ল্যান্ড দ্বীপপুঞ্জে আর্জেন্টিনা প্রায় ১০,০০০ সৈন্যের সমাবেশ ঘটায়। তবে এদের অধিকাংশই ছিল সাধারণ সৈনিক ও তারা সুপ্রশিক্ষিত ছিল না। প্রত্যাশামাফিক আর্জেন্টিনার জনগণ তাদের রাষ্ট্রপতির এই পদক্ষেপে খুশি হয় এবং রাষ্ট্রপতির প্রাসাদের সামনে প্লাসা দে মাইয়ো চত্বরে জনতা এই সামরিক পদক্ষেপের সমর্থনে জড়ো হয়।
জাতিসংঘ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও পেরু দুই পক্ষের মধ্যে সমঝোতার চেষ্টা চালায়। জাতিসংঘে আর্জেন্টিনাকে ফেরত যাবার জন্য প্রস্তাব উত্থাপন করে আন্তর্জাতিক চাপ সৃষ্টি করা হয় (৫০২ নং প্রস্তাব)। কিন্তু গালতিয়েরি তার সিদ্ধান্তে অটল থাকেন। এই আক্রমণের প্রেক্ষিতে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী মার্গারেট থ্যাচার দ্বীপগুলি পুনরুদ্ধারের জন্য নৌবাহিনীর একটি টাস্ক ফোর্স গঠন করেন। ৫ই এপ্রিল নাগাদ যুক্তরাজ্য ঐ এলাকায় ২০টি যুদ্ধজাহাজ, সহযোগী নৌযান ও ৬,০০০ সেনার এক বহর পাঠায়। ৭ই এপ্রিল যুক্তরাজ্য ফক্ল্যান্ড দ্বীপপুঞ্জের আশেপাশের ২০০ মাইল পরিধির ভেতরে বিদেশী শক্তির অবস্থান নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। বেশির ভাগ ইউরোপীয় শক্তি যুক্তরাজ্যের পক্ষ নেয়। কিন্তু বেশির ভাগ দক্ষিণ আমেরিকান দেশ আর্জেন্টিনার পক্ষ নেয়। এর মধ্যে একমাত্র ব্যতিক্রম ছিল চিলি। বিগ্ল প্রণালীতে অবস্থিত দ্বীপগুলির নিয়ন্ত্রণ নিয়ে চিলি ও আর্জেন্টিনার দ্বন্দ্ব ছিল, তাই চিলি আর্জেন্টিনার বিরুদ্ধে সতর্কতামূলক অবস্থান গ্রহণ করে। একই কারণে আর্জেন্টিনার সুপ্রশিক্ষিত সেনারা ফক্ল্যান্ড্সে না গিয়ে মূল ভূ-খণ্ডেই অবস্থান করতে থাকে। এছাড়া আর্জেন্টিনার সামরিক পরিকল্পকেরা ভেবেছিলেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এই যুদ্ধে নিরপেক্ষ ভূমিকা রাখবে। কিন্তু মধ্যস্থতায় ব্যর্থ হয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার ন্যাটো (NATO) মিত্র যুক্তরাজ্যের প্রতি পূর্ণ সমর্থন দেয় এবং তাকে সামরিক কলাকৌশল ও নানা অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে সাহায্য করে।
যুক্তরাজ্যের নৌবহর ১৩,০০০ কিলোমিটার সমুদ্রপথ পাড়ি দিয়ে আসার সময় আরেকটি ক্ষুদ্র ব্রিটিশ সেনাদল ২৫শে এপ্রিল সাউথ জর্জিয়া দ্বীপ দখলে নেয় এবং একই সাথে আর্জেন্টিনার একটি ডিজেল-চালিত ডুবোজাহাজও দখল করে। এরপর তারা পূর্ব ফক্ল্যান্ড দ্বীপে আক্রমণ শুরু করে। ২রা মে তারিখে এক বিতর্কিত আক্রমণে ব্রিটিশ একটি ডুবোজাহাজ যুদ্ধ-অঞ্চলের বাইরে অবস্থিত পশ্চাদ্পসরণকারী আর্জেন্টিনার জেনেরাল বেলগ্রানো নামের ক্রুজার জাহাজটি ডুবিয়ে দেয় এবং এতে ৩৭০ জন আর্জেন্টিনীয় প্রাণ হারান। আর্জেন্টিনা ফকল্যাণ্ড অঞ্চলে আর কোন জাহাজ না পাঠালেও ডুবোজাহাজগুলি দিয়ে ব্রিটিশ নৌবহরকে সন্ত্রস্ত করে রাখে। ১৪ই মে তারিখে ব্রিটিশ কমান্ডোরা পশ্চিম ফকল্যাণ্ড দ্বীপে নামে। ২০শে মে মাঝরাতে পূর্ব ফকল্যাণ্ডের সান কার্লোস বন্দরে মূল ব্রিটিশ আক্রমণ শুরু হয়। ২১শে মে থেকে ২৮শে মে পর্যন্ত যুদ্ধ চলে। এর মধ্যে ব্রিটিশরা শত্রুর মাটিতে পরবর্তী পর্যায়ের আক্রমণ চালানোর ঘাঁটি (bridgehead) তৈরি করে ফেলে। দুই পক্ষের মধ্যে মূল যুদ্ধ সংঘটিত হয় ২৮শে মে-তে, গুস গ্রিন এলাকায়। এতে ব্রিটিশরা জয়লাভ করে। এরপর আর্জেন্টিনীয়রা ফিট্স্রয় ও ব্লাফ কোভ-এ প্রতি-আক্রমণ চালালেও ব্রিটিশদের অগ্রযাত্রা অব্যাহত থাকে এবং ১৪ই জুন তারিখে তারা পোর্ট স্ট্যানলি দখল করে যুদ্ধে বিজয় লাভ করে। এই যুদ্ধে ২৫৮ জন ব্রিটিশ সৈন্য এবং ৬৪৯ জন আর্জেন্টিনীয় মারা যান। এই শোচনীয় পরাজয়ের পর গালতিয়েরি পদত্যাগ করেন ও আর্জেন্টিনায় সামরিক শাসনের অবসান ঘটে। অন্যদিকে যুদ্ধে ব্রিটিশদের বিজয় তৎকালীন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী মার্গারেট থ্যাচারকে একজন শক্তিশালী ও সিদ্ধান্তদানে পারদর্শী নেত্রী হিসেবে প্রতিষ্ঠা দেয় এবং ঐ বছর ব্রিটিশ সংসদ নির্বাচনে তিনি বিজয়ী হন।
যুদ্ধে বিজয়ের পর থেকে যুক্তরাজ্য ফক্ল্যান্ড্সের ব্যাপারে নতুন কোন আলোচনা শুরু করতে অনীহা দেখিয়ে আসছে। কার্লোস মেনেম আর্জেন্টিনার রাষ্ট্রপতি হবার পর থেকে দুই দেশের সম্পর্ক আবার ধীরে ধীরে স্বাভাবিকের দিকে মোড় নেয়।
তথ্যসূত্র
[সম্পাদনা]- ↑ Casualties of the Falklands War ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ৮ এপ্রিল ২০০৯ তারিখে ব্রিটিশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় ওয়েবসাইট, ১১ই জানুয়ারি, ২০০৬ তারিখে সংগৃহীত
গ্রন্থপঞ্জি
[সম্পাদনা]- Barnett, Anthony. IRON BRITANNIA Why Parliament waged its Falklands war. Allison & Busby, 1982. আইএসবিএন ০-৮৫০৩১-৪৯৩-৩
- Dalyell, Tam, MP. One Man's Falklands. Cecil Woolf, 1982. আইএসবিএন ০-৯০০৮২১-৬৫-৫.
- Dalyell, Tam, MP. Thatcher's Torpedo. Cecil Woolf, 1983. আইএসবিএন ০-৯০০৮২১-৬৬-৩.
- Femenia, Nora National Identity in Times of Crises: the scripts of the Falklands-Malvinas War. Nova Science Publishers, Inc, 1996. আইএসবিএন ১-৫৬০৭২-১৯৬-০.
- Franks et al. Falkland Islands Review, Report of a Committee of Privy Counsellors. HMSO, January 1983. Cmnd. 8787.
- Freedman, Sir Lawrence. Official History of the Falklands Campaign: Vols 1 & 2. Frank Cass, 2005. আইএসবিএন ০-৭১৪৬-৫২০৬-৭ and আইএসবিএন ০-৭১৪৬-৫২০৭-৫.
- Gavshon, Arthur and Rice, Desmond. The Sinking of the Belgrano. Secker & Warburg, 1984. আইএসবিএন ০-৪৩৬-৪১৩৩২-৯.
- Harris, Robert. GOTCHA! The Media, the Government and the Falklands Crisis. Faber and Faber, 1983. আইএসবিএন ০-৫৭১-১৩০৫২-৬.
- Kon, Daniel. Los Chicos de la Guerra, The Argentine conscripts' own moving accounts of their Falklands War (English translation). New English Library 1983. আইএসবিএন ০-৪৫০-০৫৬১১-২.
- McManners, Hugh, Forgotten Voices of the Falklands, Ebury Press, 2007, আইএসবিএন ৯৭৮-০-০৯-১৯০৮৮০-৫
- Middlebrook, Martin. The Argentine Fight for the Falklands. Pen & Sword Military Classics, 2003. আইএসবিএন ০-৮৫০৫২-৯৭৮-৬
- Norton-Taylor, Richard. The Ponting Affair. Cecil Woolf, 1985. আইএসবিএন ০-৯০০৮২১-৭৩-৬.
- Ponting, Clive. The Right to Know: The Inside Story of the Belgrano Affair. Sphere Books, 1985. আইএসবিএন ০-৭২২১-৬৯৪৪-২
- Sunday Times Insight Team. The Falklands War. Sphere Books, 1982. আইএসবিএন ০-৭২২১-৮২৮২-১.
- Tinker, Lieut. David, R.N. A Message from the Falklands, The Life and Gallant Death of David Tinker, Lieut. R.N. from his Letters and Poems. Penguin, 1982. আইএসবিএন ০-১৪-০০৬৭৭৮-৭.
- Thornton, Richard C. 'The Falklands Sting. Brassey's, 1998. আইএসবিএন ১-৫৭৪৮৮-১৫৫-৮.
- Underwood, Geoffrey. Our Falklands War, The Men of the Task Force Tell Their Story. Maritime Books, 1983. আইএসবিএন ০-৯০৭৭৭১-০৮-৪.